পারমিতা ভৌমিক




পারমিতা ভৌমিক

জন্ম---১৯৪৫,৩রা জুলাই।স্থান হাওড়া।লেখালেখির শুরু ---অল্পস্বল্প লিখছি ১৯৭১ থেকে।তখন স্কুল লাইফ। তারপর কলেজ ম‍্যাগ ও স্থানীয় কিছু ম‍্যাগাজিনে --- প্রগতি, চা-বুক,আশাবরী, অভিযাত্রী, অকৈতব, ঋপত্রিকা ক্ষণপ্রভা। এছাড়াও আছে--- স্মার্টি, প্রমিতাক্ষর, শব্দ, যাজন,আমার রূপসী বাংলা, আরাত্রিক,মনছবি, সবুজ কথা। বড় পত্রিকা--কবিপত্র, উদ্বোধন, শৃণ্বন্তু, সন্ধিৎসা,লোকসখা, দিবারাত্রিক কাব‍্য, মাতৃশক্তি, জাগ্রত বিবেক, প্রাকভাষ, শ্লোক, কবিতা আশ্রম,শিলীন্ধ্র, চিত্রকল্প, মধুসূদন দরিপার পত্রিকার নাম ভুলে গেছি। চিন্তক।শৈবভারতী।ঝরাপাতা। প্রকাশিত গ্রন্থ:- পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের অন‍্য অনন‍্য মহাকবিতা,অন‍্য অনন‍্য প্রবন্ধ সংগ্রহ প্রথম খণ্ড। দ্বিতীয় খণ্ড ---যন্ত্রস্থ।গ্নি আলোয় দেখি ভুবনখানি (যন্ত্রস্থ)।


সাহিত্যে পার্সোনাল-মিথ ও ডিমিথ এবং               আমার কালের কয়েকজন কবি।

পারমিতা ভৌমিক


মিথের সামগ্রিক আলোচনার ক্ষেত্রটি আমার এই প্রবন্ধে আলোচ‍্য নয়। আমি পার্সোনাল মিথমেকিং এর কথা বলবো।

সামাজিক কোন প্রেক্ষিত বা ঘটনার ছায়া থেকেও myth-জাতীয় রচনা তৈরি হতে পারে এবং কবিতা সাহিত‍্যে বিশেষতঃ তা হয়েছেও। সামাজিক ও ব্যক্তিগত অনুভব,অনুভূত সত্য, উপলব্ধ-ছবি দিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা যখন জীবনকে ব্যাখ্যা করেন তখন বৃহত্তর ক্ষেত্রে সেগুলিকেই কেউ কেউ ব্যক্তিগত বা personal myth বলেন।আমি একেই পার্সোনাল মিথ বলতে চাইছি। 

কবি,পাঠক ও আলোচকমাত্রই জানেন যে মনের অনুভূত-সত্য, সত্য-দর্শন,myth এর আশ্রয়ে প্রতীকময়তা লাভ করে কেননা কবিতার ছোট্ট canvas - এইসব ব‍্যক্তিগত সত‍্য এবং দর্শনকে প্রকাশ করবার জন‍্য উপযোগী হয়ে উঠতে চায় আর কাব‍্যসাহিত‍্যে সেই প্রকাশ ,সেই প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে বলেই পার্সোনাল মিথ সৃজিত হয়। 


অতএব আমার এই রচনাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো  কবিতায়  মিথের নতুনতর ব্যবহার, এর আঙ্গিক, এর চিত্র ও তার ব্যাখ্যা করা।মূলতঃ আধুনিক  কবি ভাবনার আলোকে মিথের নতুন মাত্রায় ব্যবহারের এই (পার্সোনাল মিথ মেকিং)দিকটিকেই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা। একথা ঠিক যে মিথ আবহমানকালের ধারাস্রোতে বয়ে চলেছে।  শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধাকৃষ্ণ -প্রেম কথা একটি myth--এ পর্যবসিত হয়েছে ভাগবতের অভিক্ষেপে। রামায়ণ-মহাভারতের পুরোটাই myth। এখানে এই classic কাব্যের  লোকায়ত রূপান্তর পাই কৃত্তিবাস ও কাশীরাম দাসের রচনায়।মঙ্গলকাব্য একটি লৌকিক myth নির্ভর কাব্য,এর রূপান্তর হয়েছে ঠিক বিপরীতক্রমে---আর্যিকরণের প্রেক্ষাপটে। 

          

আধুনিক বাংলা কাব্য ও কবিতায় লৌকিক myth এর ব্যবহার খুব সাবলীল ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে আজো। গত কয়েক দশক ধরে কবিদের কবিতায় এমনটি দেখেছি আমরা এবং আজকের কবিরাও mythগুলিকে কবির স্বভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাঁদের personal mythবা subjective myth রচনার প্রয়াস করেছেন। কোথাও সে  myth হয়েছে বিশেষ নাম্নী এক নারী, যার চিরন্তনত্ব ছিল , আছে এবং থাকবে। কোথাও কবিরা প্রকৃতির অনুষঙ্গে নিজস্ব ভাবনা মিশিয়ে তৈরি করেছেন nature myth,কোথাও বা nature myth এর চিরাচরিত style কে অতিক্রম করে, কবিরা তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন বিশেষ সমাজভাবনা ।সেগুলি সম্পূর্ণ social myth নয় কিন্তু তারি সঙ্গে প্রকৃতির সংযুক্তি সৃষ্টি করেছে নতুন myth ,বলা যেতে পারে এই বিশেষ ধারণাটি  আধুনিক কবিদের কবিতাতে বেশি প্রাঞ্জল। যেসব কবিরা এমন পার্সোনাল মিথ রচনা করেছেন তাদের সকলের নামোল্লেখ বা উদ্ধৃতি এই অল্প পরিসরে দিতে পারা গেল না। পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন।কারো কারো কবিতার উল্লেখ করতে হয়েছে কেবল মূল বিষয়ভাবনাকে আলোকিত করতে চেয়েছি বলে। সেখানে কোনো আত্মপর বিচার নেই। ছোটবড় কবিত্বের বা পরম্পরার নিয়মানুগ পারম্পর্য রক্ষার কথাও ভাবছি না। কেবল বিষয়ভাবনাটি প্রতিপাদিত করতে যতটুকু প্রয়োজন তা নিয়েছি।


কবিদের  সমাজ সংসার জনজীবনের কাহিনী মিথ হয়ে যায় যেমন দেখেছি জয় গোস্বামীর কবিতায়।তাঁর কবিতায় ন‍্যূনতমের চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে বৃহত্তমের চেতনায়। কবির কবিতায় উঠে এসেছে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির কাহিনী---লালগোলা এক্সপ্রেস, চালবিক্রয়কারিণীদের কষ্টের ছবি। তা আজো পাঠককে অভিভূত করে রাখে।

মানুষের বেদনার কথা ভেসে উঠেছে আর এক কবির সরসরি প্রত্যক্ষণে ---তিনি কবি শ্যামলকান্তি দাস... তাঁর একটি কবিতার নাম " সর্বনাশ " ----

"সূর্যের উৎসসন্ধানে দেবতারা

সেই যে কবে সমতলে নেমেছেন,

এখনও বাড়ি ফেরার নাম নেই।"

( একলা পাগল)

সূর্যের উৎসসন্ধান ও দেবতারা মিথ হয়ে গেছে।দেবতারা মানুষের ভূমিতে এসেছেন মানুষকে কর্ষণকরে দেবত্ব খুঁজতে যেমন করে পিতা নিজেকে খোঁজেন পুত্রের মধ‍্যে‌। অপুরুষ ও পুরুষের মিলনে সেই যে দেবত্বের খোঁজ রয়েছে তার উৎস শ‍্যামলকান্তির সজ্ঞান বেদনাবোধের মধ‍্যে।এ তাঁর সমাজসঞ্জাত কষ্টও বটে। এটিকে পার্সোনাল মিথ বলতেই স্বচ্ছন্দ লাগে। শ‍্যামলকান্তির আরেকটি কবিতার ছত্র পড়বো----" ঐরাবতের সবুজ চক্ষু আনছে টেনে পাহাড়/আমার এখন কিসের তাড়া,কোথায় যেতে হবে,/ আকাশ আবার সমুদ্রকে গানের মত লিখুক।"(টান/একলাপাগল)...

ঐরাবত এসেছে মিথ হয়ে।তার সঙ্গে গভীর জীবন বীক্ষণ সবুজচক্ষু হয়ে ধরা দিয়েছে শ‍্যামলের কবিতায়।

কবি প্রমোদ বসুর কবিতায় দেখি ব‍্যক্তিগত ব‍্যথার নিরিখে এসেছে মিথ---"কারা খুব এ তল্লাটে/রাতভোর চন্দ্রে থাকে?/কারা খুব সমস্বরে /মদনের ভস্ম মাখে?" (কবিতা সমগ্র/জন্মদিনের দুঃখ)

অজিত বাইরীর কবিতা আজকের দশরথ--এ মিথ এসেছে কান্না হয়ে।আজকের পিতা আর রামায়ণের দশরথের কান্না কবির লেখনীতে পেয়েছি।

কবি মলয় গোস্বামীতে কত যে পার্সোনাল মিথ এসেছে তা পাঠক মাত্রেই জানেন। একটি কবিতায় মন দেব ।পাঠক সঙ্গে থাকুন। চাঁদবেনে কেমন অবলীল মিথ হয়ে ঢুকে পড়েছে কবিতায়---"আমার শরীর থেকে অনেক আলোককণা/অনেক সাপের ফণা বেরিয়ে পড়েছে কাল রাতে/আমি হাতে হেঁতালের সরু এক ডাল/ফণাতে ঠেকিয়ে বলি,নিচু হও...নিচু হও"(আমার ক্ষুধার্ত লেখা)

হেঁতালের ডাল আর সাপের উদ‍্যত ফণা মিথ তৈরী করেছে অপ্রতিবাদের । কবির ব‍্যক্তিযন্ত্রণার। আরেকটি কবিতায় মলয়ের পার্সোনাল নেচার মিথ ভেসে ওঠে ---" টানা দুই পাহাড় আর

 টানা দশ ....নদী

পার হ'য়ে

গাছ ও গাছের বাচ্চা ক্লান্ত হ'য়ে শোয়।"

            আধুনিক কবি, অগ্নি বসু একটি nature-myth রচনা করেছেন তাঁর "হলদে পাখির ডানা" কবিতায়। এই myth-এ সামাজিক যন্ত্রণার ছবি আছে।তার সঙ্গে মিশেছে কবির রোমান্টিক বেদনাবোধ। কবির দৃষ্টিতে মনে হয়েছে নারীর কাছে সংসারখাঁচাটি প্রলোভনের বস্তু। পাখিধরারা সমাজ জীবনের ঘূণ-ধরা একদল মানুষ, খাঁচায় করে বন্দী করে স্বাধীন পাখিদের, সংসার খাঁচায় । বন্দী করবে বলে মিষ্টি সুরে ডেকে নিয়ে। নারী ভুল ইচ্ছায়, নরম গোলাপি ঠোঁটে আঁকড়ে ধরে খাঁচাটি,বলে,' এ ঘরেই থাকবো আমি', হাত ছেড়ে দেয় শাশ্বত ও নিষ্ঠ প্রেমিকের। সেও এক ভুল ভাবনায় ----

"ভিজে মাটিতে মরা গাছের একটা ডাল পুঁতে রাখা

 তার ডগায় ধাপে তৈরি খালি খাঁচা ঝুলিয়ে রেখেছে পাখিধরা একটা লোক।

বাঁশঝোপের আড়ালে বসে অবিকল পাখির গলায় সে ডাক দিচ্ছে মি--ঠু--ঠু মি--ঠু--ঠু

মিঠু কি কোন পাখির নাম

সে ডাক শুনতে পেয়ে উর্মি পাখি হয়ে গেল ,হলুদ বেনে বৌ পাখি

গোলাপি ঠোঁট বাঁশের খাঁচার গায়ে ঘষতে ঘষতে হলুদ কালো ডানা নেড়ে ও বললো,

কি সুন্দর ঘর বানিয়েছো পাখি ওলা, এই ঘরেই থাকবো আমি"।(হলদে পাখির ডানা/ ডাকছো নদী যাই)

যীশুর মিথ ধরা দিয়েছে আবদুস শুকুর খানের কবিতায়! কি অদ্ভুত মাত্রায় এসেছে ---"তোমার পাথর পায়ে গুচ্ছ শিকড়/ জবাফুল ঢাকা তোমার পায়ের পাতায় ক্রুশবিদ্ধ পেরেক ।/আমার হাত ডুবে যাচ্ছে টাটকা রক্তে, আর তুমি/চেয়ে আছ শান্ত নির্ভরতার চোখে,শূন‍্য বিস্ময়ে...."(যিশু/সময়ের যতি চিহ্ন ভেঙে)। 

বস্তুতঃ মিথের ব‍্যখ‍্যা যেভাবেই করা হোক না কেন, মিথের পুনর্গঠন যেখানে প্রতিপাদ‍্য বিষয় সেখানে খুব স্বাভাবিকভাবেই কবিদের  প্রকাশভাবনা ও প্রকাশভঙ্গী সাবজেক্টিভ হয়ে যাবে।আসলকথা সব ঘটনার পিছনেই নিহিত যে সত‍্য তাকেই মানুষ ও কবিরা মিথ রূপে আবিস্কার করেছেন ও সৃষ্টিও করেছেন।

কবি উমা বন্দোপাধ‍্যায় প্রচুর পার্সোনাল মিথ তৈরী করেছেন---"আর বোকা এক বুলবুলি/ সজনেতলার মাটি থেকে/একটুকরো দুঃখ কুড়িয়ে খুঁটে খুঁটে খেতে বসল।

*  *       *         *      *     *

এমন এক বিকেলবেলার গল্প শুনে/ নীল সাদা স্কুলড্রেস/মস্ত এক কলেজের বাসে উঠে পড়ল।"

আরো একজন কবির কথা বলবো যাঁর কবিতা সম্ভারে পার্সোনাল মিথ তৈরীর ঝোঁক মুগ্ধ করে, তিনি পঙ্কজ মান্না----

" সারাবেলা জাল বোনে হারাধন কাকু,/ কণ্ঠে তার মানভঞ্জন পালা কিম্বা মাথুর!/প্রভাদিদি এখনো কী একাদশী তিথি/নীরম্বু উপোষে কাটে চিন্ময় প্রহর !"

আরো বেশ কিছু কবির কবিতায় এমন প্রচুর সুন্দর  পার্সোনাল মিথের আলোচনা বাকি রইলো...

সেসব পক্ষান্তরে বলার ইচ্ছে রইল।পরের কোনো প্রবন্ধে বলা যাবে। অথবা এই সূত্রধরে , এই রচনাতেও,পাঠক যোগ করতে পারেন আরো পার্সোনাল মিথ।



Comments

Popular posts from this blog

মনিশঙ্কর

মজিদ মাহমুদ

কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমীরুল আরহাম