মজিদ মাহমুদ



মজিদ মাহমুদ

জন্ম:-১৬ এপ্রিল,১৯৬৬,

পাবনায়। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। লেখালেখির হাতে খড়ি শিশুবেলা থেকে। কবিতা তাঁর নিজস্ব জগৎ হলেও গবেষণার কাজেও তিনি দক্ষ। নজরুল ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে কাজ করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩২।

উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ:- বল উপাখ্যান,আপেল কাহিনী, ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম,মাহফুজামঙ্গল,কাব্য সঞ্চয়ন প্রভৃতি।

প্রবন্ধগ্রন্থ:- ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ,কেন কবি কেন কবি নয়, নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র, রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবর্ষ প্রভৃতি।




       বুদ্ধদেব বসুর জীবনানন্দ দাশ: নতুুন                  আলোকে আন্তরিক বিশ্লেষণ

                কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ

জীবনানন্দ দাশকে আজ আমরা যত ভাবে চিনি, তার প্রথম পরিচয়টি করিয়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এটি সাহিত্যের ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়ট-এর বিখ্যাত ওয়েস্টল্যান্ড কবিতাটি কিছুটা ঘষামাজা করে এজরা পাউন্ড ছাপার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন; তার আগে অবশ্য প্রæফকের ভালোবাসার গানেও হাত লাগিয়েছিলেন তিনি। এলিয়ট ওয়েস্টল্যান্ডের উৎসর্গ পত্রে পাউন্ডকে উস্তাদ কারিগর হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, অথচ এই দুই কবির বয়সের পার্থক্য ছিল খুব সামান্য; পাউন্ড ছিলেন এলিয়টের চেয়ে মাত্র বছর তিনেকের বড়; কিন্তু কবি হিসাবে এলিয়টের আগেই তিনি মান্যতা পেয়েছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ আর বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেছিল ঠিক উল্টো। বুদ্ধদেব বসু যদিও জীবনানন্দ দাশের উস্তাদ নন, কিন্তু তাঁর উস্তাদি গুণের কারণে তৎকালীন আত্মরতিময় সাহিত্যের জগতে জীবনানন্দেরও কিছুটা ঠাঁই হতে শুরু করেছিল। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর মধ্যে পাউন্ড-এলিয়টের তুলনায় বয়সের বিস্তর পার্থক্য ছিল।

জীবনানন্দ দাশের চেয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রায় বছর দশেকের কনিষ্ট হলেও দুজনই তিরিশের দশকের শক্তিশীলী কাব্যনির্মাতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তবে বয়সের বিস্তুর পার্থক্য সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসুর কাব্যখ্যাতি  বাংলা কবিতার পাঠকদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল।আঠাশ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক' প্রকাশিত হলেও গ্রন্থখানি সুধীমহলের খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। 

বিশেষ করে তাঁর এই কাব্যের মূল সুরের সঙ্গে তাঁর অগ্রে প্রতিষ্ঠিত কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অঙ্গশৈলিতে মিল থাকায় তাঁর মৌলিকত্ব কিছুটা দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। ১৯৩৬ সালে জীবনান্দ দাশের ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর বিশেষত্ব সুধীমহলকে নাড়া দিতে পারেনি। আর ততদিনে বুদ্ধদেব বসুর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; বিশেষ করে ‘বন্দির বন্দনা’ (১৯৩০), ‘পৃথিবীর পথে’ (১৯৩৩) রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; তাছাড়া 'প্রগতি' ও 'কবিতা' পত্রিকার সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি ততদিনে সাহিত্যের একজন কেউকেটায় পরিণত হয়েছেন; তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করার তৎকালীন তরুণ তুর্কিদের জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। এমনকি তাঁর প্রচেষ্টার ফলে পরবর্তীকালে কবিতায় পাণ্ডব বংশের সৃষ্টি ও স্বীকৃতি ত্বরান্বিত হয়েছে; নিজের ছাত্রীকে দিয়ে বাংলাকাব্য পরিচয়ের অভিসন্দর্ভ রচনা করে একাডেমিতে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিচ্ছেন। 

এ কথা আজ সত্যিই গভীরভাবে ভাবার দরকার আছে; বুদ্ধদেব ছাড়া আর এমন কোন সুহৃদ- যাঁর দক্ষিণহস্ত ছাড়া এই পান্ডববর্জিত কবির কী দশাই না হতো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন সমকালীন কবিদের প্রতি আশার বাণী বর্ষণ করে চলছেন, তখনো জীবনানন্দ দাশের জন্য তা অবারিত ছিল না। ভালো কবিতা লেখা যেমন একটা ক্ষমতার পরিচায়ক, তেমনি ভালো কবিতা পাঠের রুচি তৈরিও সাহিত্যে একটি ঘটনা। জীবনানন্দ যদি সত্যিই ভালো কবিতা লিখে থাকতেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা কাব্যপাঠককে আকৃষ্ঠ করতে পারল না কেন? এই প্রশ্নটির মধ্যেই নিহিত আছে বুদ্ধদেব বসুর মতো উস্তাদ কারিগরের কারিশমা। 

জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের পরপরই বুদ্ধদেব বসু একটি নাতি দীর্ঘ সমালোচনা লিখে এই কবিকে পাঠ করার জন্য পাঠককে রীতিমত জবরদস্তি করতে থাকেন। তার ভাবখানা, এমন উমদামাল বাংলা কবিতায় এর পূর্বে কখনো দেখা যায়নি; আর এখানেই বুদ্ধদেব বসুর মহত্বের জুড়ি মেলা ভার। কেননা বুদ্ধদেব ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত আত্মমুগ্ধ একজন লেখক, যিনি চাইলেই জীবনানন্দ দাশের বিষয়-শৈলির মৌলিকত্ব তুলে তার বারোটা বাজাতে পারতেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু সারাজীবন তার পূর্বসূরি রবীন্দ্র-নজরুলের মতো সাহিত্যে সম্ভাবনাময় সকল কিছুকে উর্ধে তুলে ধরেছেন। 

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় দুই দশকে বুদ্ধদেব বসু জীবননানন্দ দাশকে নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের একই বছরে তার রচিত ‘জীবনানন্দ দাশ : ধূসর পাণ্ডুলিপি’ শীর্ষক রচনায় কবি সম্বন্ধে যে সব মন্তব্য করেছিলেন, দুর্ভাগ্য সৌভাগ্যবশত সেগুলোই কবির নামের সাথে মার্কা মেরে গেছে। আমি ঠিক জানি না, ধূসর পান্ডুলিপির কবিকে ‘প্রকৃতির কবি’ বলা যায় কিনা। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তাকে সেদিন প্রকৃতির কবি বলেই উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রকৃতির বিপুল সম্ভার সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশকেই প্রকৃত প্রকৃতির কবি হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। যদিও প্রকৃতির কবি শুনতে অনেকটা গ্রামীণজীবনের কাব্যনির্মাতা মনে হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু জীবনানন্দ দাশের চেতনার মধ্যে মোটেও গ্রামীণ জীবনের শাদামাটা জীবনচিত্র ছিল না। তবে আমার মনে হয়, বুদ্ধদেব বসুর সেদিনের এই আবিষ্কারটি যে যথার্থ ছিল, শেষ পর্যন্ত কবির ‘রূপসীবাংলা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার পরিণতি পেয়েছে; যদিও এই কাব্যগ্রন্থটি কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। 


বুদ্ধদেব বসু তাঁর এ আলোচনায় জীবনানন্দ দাশকে গভীর থেকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি তখনো তাঁর নামটি এমনই অপরিচয়ের আবরণে ঢাকা ছিল যে, তাঁর নামটি পর্যন্ত অধিকাংশ লোক শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে পারতেন না, শ্রীমান বসুর ভাষ্যানুসারে লোকে বলতেন, ‘জীবানন্দ’। যদিও বুদ্ধদেব এটা উল্লেখ করতে ভোলেননি, ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়লে অনেকেরই তরুণ ইয়েটস, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলিয়টকে মনে পড়তে পারে; তবু তিনি যা করেছেন তা বাংলা কবিতার জন্য সম্পূর্ণ নতুন। তার বিষয় আঙ্গিক ভাষা পরিবেশনা তার পূর্ববর্তী সকলের চেয়ে আলাদা; এমনকি দুরুহ ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের থেকেও তিনি আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। বুদ্ধদেব বসুর পর্যবেক্ষণ হলো, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র ছন্দটিকে তিনি অবলম্বন করেছেন বটে কিন্তু তার চলনের ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। অথচ মাত্র বছর আটেক আগে এই কবিই তার পূর্বসূরীদের পথ ধরে কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন।

জীবনানন্দ দাশের স্বভাব এবং তার কাব্যের নতুনত্ব দেখে বুদ্ধদেব বসু এ আশঙ্কা করতেও ভোলেননি যে, তিনি বাঙালি কাব্য সমাজে অপরিচিত থেকে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কারণ থাকবে না। কিন্তু সে পথের কাঁটা বুদ্ধদেব বসু কিছুটা দূর করে দিয়েছিলেন এই স্বীকৃতি তাকে দিতেই হবে। বনলতা সেন লেখার ফলে জীবনানন্দ দাশকে সাধারণ কাব্যপাঠকগণ প্রেমের কবি হিসাবে উল্লেখ করলেও বুদ্ধদেব বসু টের পেয়েছিলেন, প্রেমের কবিতা লেখা এই কবির ধাতে নেই; দু’একটা চরণ কখনো নর-নারীর প্রেমের অনুষঙ্গ হিসাবে ঝলসে উঠলেও পরক্ষণেই জীবনের গহীন-গহন অন্ধকারে তা হারিয়ে গেছে। আমার মনে হয়, জীবনানন্দ দাশের কাব্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে চিত্রকল্পময়তার অনুযোগ তুলেছিলেন, সেটিও মনে হয় বুদ্ধদেব বসু থেকে ধার করা; কারণ বুদ্ধদেব বসু ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর পরই বলেন, ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যে দেখা যায় যে চিত্ররচনার অজস্রতা, তার বিশেষত্বও উল্লেখযোগ্য। যত উপমায়, যত ইঙ্গিতে তিনি কল্পনাকে প্রকাশ করেন, সেগুলি ভাবাত্মক নয় রূপাত্মক; চিন্তাপ্রসূত নয়, অনুভূতিপ্রসূত।’

জীবনানন্দ দাশের কবিতার কৌশল নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, এই কবির কান অত্যন্ত সজাগ। ছন্দকে ইচ্ছে মত বেকিয়ে-চুরিয়ে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন। যেখানে বাধা পেয়েছেন সেখানে বাধাটাই যেন কবির অভিপ্রেত। ইংরেজি শব্দগুলিকেও তিনি এমনভাবে বাংলার সাথে মিশেল দিয়েছেন, যাতে মনে হয় এই শব্দগুলি যেন এই ধরনের সম্পর্কের জন্য অপেক্ষা করেছিল। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য এটি দেখাতে ভোলেননি যে, কোথায় তিনি শেলি, কীটস, সুইনবার্গ, এলিয়ট বা ইয়েটসের শরণাপন্ন হয়েছেন। তবে তিনি একবারও বলেননি, এ সব গ্রহণ ও আত্মিকরণ বাংলা কবিতার জন্য, কিংবা জীবনানন্দ দাশের জন্য মন্দ হয়েছে; বরং এটি যে কবির জন্য দুর্বার ক্ষমতার প্রশ্ন এটিই স্বীকার করেছেন। কারণ, তিরিশের প্রায় সকল কবিই ইংরেজি সাহিত্য ভালো করে পাঠ করেছেন বলে প্রমাণ মেলে; কিন্তু জীবনানন্দ দাশ যে ক্ষমতা ও নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা আর কারো জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।



'বনলতা সেন' প্রকাশের পরেও বুদ্ধদেব বসু ১৯৪৩ সালে তাকে নিয়ে একইভাবে আলোচনা করেন। এ সময়ে জীবনানন্দ দাশ যথেষ্ট পরিণত হলেও কবিখ্যাতি তার জন্য খুব একটা বিস্তার লাভ করেনি; ফলে বুদ্ধদেবের প্রচারের দায়িত্বটি তার জন্য জরুরি ছিল- এটি বলাই যায়। তিনি টের পেয়েছিলেন যে, তাঁর কবিতা পড়লে যে-ভাবে কানে লেগে থাকে সে অনুপাতে পাঠক তাঁকে তখন পর্যন্ত নিতে পারেননি; বরং কবিসমাজ ভেতরে ভেতরে তার অনুকরণের লোভ সম্বরণ করতে পারছেন না। তবে বুদ্ধদেব বসুদের মতে তিরিশের দশকটি বাংলা কবিতা মূলত ঐতিহ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় অতিক্রম করছে; সেদিক দিয়ে জীবনানন্দ দাশ তখন পর্যন্ত কবিতার প্রতি অনুরক্ত রয়েছেন; যদিও বুদ্ধদেব বসু বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখেছেন, তবু এটি জীবনানন্দ দাশের জন্য এটি একটি শ্লেষাকারে উপস্থিত ছিল।

জীবনান্দ দাশ প্রয়াত হওয়ার পর পরই বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৫ সালে ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’ নামে একটি বড়সড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধে একজন কবি জীবনানন্দ দাশ ও মানুষ জীবনান্দ দাশকে যেভাবে তিনি অঙ্কন করেছেন, আমি গভীরভাবে লক্ষ করেছি যে, পরবর্তী জীবনানন্দ ব্যাখ্যাতাদের জন্য খুব বেশি নতুন কিছু বলার রাখেননি; তথ্য ও টীকাটিপ্পনি ছাড়া। যদিও তার অনেক মতের পক্ষ বিপক্ষ যুক্তির অভাব নেই; তবু সেগুলিকে আবর্তন করেই মূলত জীবনানন্দ দাশের কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এখনো এগিয়ে চলছে।





Comments

Popular posts from this blog

মনিশঙ্কর

কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমীরুল আরহাম